বাক্ ১০৭ | বঙ্কিমচন্দ্র | অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত | সপ্তম পর্ব




সহপায়ীবৃন্দ   
দুপুর গনগনে। লেবুবাগানস্থিত বাঙলা মদের ঠেক ও বেশ্যাপল্লীর ভিতর, ‘ভিতর’-এর পর এই কমাটি লক্ষণীয়। আপনি বিরাট বাহির থেকে একটি ভিতরে ঢুকলেন বা আপনাকে ঢুকতে বলা হ’ল। ঢুকে আপনি কিছু মুহূর্ত দাঁড়াবেন এবং এই ঢোকা ব্যাপারটিকে সম্মান দিয়ে তাকে সেলিব্রেট করার জন্যেই দাঁড়াবেন। তো লেবুবাগানস্থিত বাঙলা মদের ঠেক ও বেশ্যাপল্লীর ভিতর, কোন একটি তলার একটি ঘর হ’তে এক যুবক কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। বৈশাখের একপ্রকার লু সেদিন আছড়ে পড়ছে রাস্তার বাড়ি ও দোকানের দেওয়ালে। পথচলতি মানুষ, যাঁরা কোনোক্রমে গন্তব্যে পৌঁছানোর কথা ভাবতে ভাবতে রাস্তায় নেমেছে ও চলছে। তাঁদের শরীরস্থিত প্রাচীরেও আছড়ে পড়ছে, লু। অতি গ্রীষ্মে হোমো-সেপিয়েন্সের মস্তিষ্ক তখন এটুকুই ভাবছে, কখন সে তার গন্তব্যে পৌঁছাবেলেবুবাগানের আর কোন গন্তব্য নেই। পৃথিবীর কোন পানশালা ও বেশ্যাপল্লীরই থাকে না। লেবুবাগানেরও নেই। এখানে প্রথমবার প্রবেশের আগে প্রতিটি লোকেরই মস্তিষ্কের কোন কোষে একটি বাগান, বাগানে একটি গাছ, এবং গাছে অপরিণত স্তনাকৃতির ন্যায় ঝুলন্ত গন্ধরাজ উঁকি দেয় নিশ্চয়। এইভাবে দৃশ্যকল্পনার সাথে তাঁদের নাসারন্ধ্রও সজাগ হয় কিঞ্চিৎ। নাকের পাটার ভিতরের রোঁয়াগুলিও এমন লেবুদৃশ্য কল্পনার সাথে একপ্রকার হাওয়া থেকেই বলা যেতে পারে কতকটা ম্যাজিসিয়ানের মতো লেবুগন্ধ পেড়ে আনে ও নাকে ঢুকিয়ে দেয়। লেবুবাগানস্থিত বাঙলা মদের ঠেক ও বেশ্যাপল্লীর ভিতর, কোন একটি তলার একটি ঘর হ’তে এক যুবক কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। তার গলায়, জিভের উচ্চারণে, সুরাশিল্পীর পরিচয়জ্ঞাপক মত্ততা ও মগ্নতা। তথা বুঁদ। অন্যান্য কন্ঠস্বর যা কিছু শোনা যাচ্ছে, তা ক্ষীণ। বোধগম্য হয় তা ভাষায় বাঙলা। কিন্তু আশেপাশের সেই মানব স্বরের ধ্বনিগুলি শব্দে এবং শব্দগুলি বাক্যে গঠিত হয়ে নীচে, বাইরে, গলিতে এসে স্পষ্ট বোধগম্য আকার নিচ্ছে না। নিতে পারছে না। নীচ অবধি সেই স্বরগুলি নেমে আসার আগেই ভেঙে যাচ্ছে। ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে প’ড়ে যাচ্ছে পানশালার দোতলার তিনতলার সিঁড়িতে, সিঁড়ির খাঁজে। কিম্বা বায়ুতে উদ্বায়ী হয়েও যেতে পারে কিছুটাআমরা এও ধরে নিতে পারি যে, বায়ুতে উদ্বায়ী সেই ধ্বনিকুল বা শব্দকুল বাঙলা মদের খোলা বোতল ও গেলাসগুলিতে, ঐ তরলেও গিয়ে বসছে কিঞ্চিৎএবং উপস্থিত মদ্যপায়ী তথা সুরাশিল্পীরা বোতল বা গেলাসস্থিত মদ্য পান করার সাথে কিঞ্চিৎপূর্বে তাঁদেরই মুখনিঃসৃত শব্দ কিছুটা ক’রে হলেও পান করছে। অজান্তেই। তবু করছে। যেহেতু অনিবার্য। তাই অপ্রতিরোধ্য। গ্যাসের গুঁড়োর মতো সূক্ষ্ম সেই শব্দ তাঁদের পান করতেই হচ্ছে। মানুষ স্বীয় বা বন্ধুজনের বমি, যা উদ্গৃত হয়েছে, পান করলে যেরূপ হয়। তবে, শব্দ হল রস স্বরূপ, রস নিঃসৃত হয়। শব্দও। বমি এতটা শান্ত নয়। সে হড়হড়, সে উদ্গৃত। লেবুবাগানস্থিত সিক্সটি আপ দিশী মদের পানশালা ও বেশ্যাপল্লীর ভিতর, কোন একটি তলার একটি ঘর হ’তে এক যুবক কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। কন্ঠে সঙ্গীত। সঙ্গীতে কীর্তন। দিশী মদের পানশালায় এ ভিন্ন আর কী সঙ্গীত উপস্থাপিত হতে পারে! যেখানে মদও দিশী। কীর্তনও। উভয়েরই খাঁটি স্বদেশীয়ত্বে কোনো ত্রুটি নেই। মত্ত ও মগ্ন যুবকের কন্ঠে সেই আদি অকৃত্রিম চিরায়ত প্রাচীন কীর্তন। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরেকলিযুগের নব গায়ত্রী। বোঝা যাচ্ছে সুরও রস স্বরূপ। সেও নিঃসৃতগামীতার দলে। পর্বতগুম্ফা থেকে যেমন উষ্ণ জলপ্রবাহ নির্গম ও নিঃসৃত হয়, কীর্তনের এই সুরও তাই-ই। চুম্বনের মুহূর্তে যেরূপ মনে হয়, চোখ বুঁজলে অনুভূতি গাঢ় হবে। কীর্তনের এই সুর গাইবার সময়েও চোখ বোঁজার একটা অনুভূতি উপলব্ধ হয়। যদি নীচ থেকে যুবকটি দৃশ্যগোচর নয়, কিন্তু যথেষ্ট স্পষ্টভাবে শ্রাব্য। শ্রুতি ও অনুমানেন্দ্রিয় বলছে যুবকটি নিশ্চয় চোখ বুঁজে গাইছে। যুবকটি কেউ নয়, মাইকেল মধুসূদন। তাঁর দু’পাশে কমলকুমার ও বঙ্কিমচন্দ্র। বাবু কমলকুমার বাঙলার পাঁইটে কমলালেবুর রস মিশিয়ে দিয়ে দিয়েছেন মাইকেলকে। তাই খেয়ে মধুসূদন চিত্তির। গলা খুলে গেছেখ্রীষ্ট ভুলে হরি ধরেছে।
পাটভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি প’রে এসেছেন কমলকুমারনুন-ছোলা আর কাঁচা লঙ্কা খাচ্ছেন মাঝামাঝে। এতক্ষণ বঙ্কিমের কাছে শুনছিলেন তাঁর কোচবিহারের অভিজ্ঞতা। অরুণেশের গল্প। রাজপ্রাসাদের দস্তাবেজখানার কথা। ব্রিটিশ-পূর্ব প্রাচীন বাঙলা গদ্য নিয়ে বঙ্কিমের কথা শুনছিলেন আগ্রহ ভ’রেনরনারায়ণের লেখা ষোড়শ শতকের চিঠির কথা শুনে বললেন, ‘‘বঙ্কিম, প্রাচীন বাঙলায় গদ্য রচনা একেবারে যে নেই তা নয়। আছে। তবে অল্প। ইতস্ততঃ। বিক্ষিপ্ত। কিন্তু তা ভীষণ গাম্ভীর্যপূর্ণ। এবং স্মার্ট। ইংরেজিয়ানার খোকাগদ্য নয় একেবারেই তাপদকল্পতরুতে আছে বিদ্যাপতি চণ্ডীদাসের পদ্য গদ্যময় রচনার কথা। চৈতন্যদেবের সহচর রূপগোঁসাই-এর লেখা একটা গদ্য পুস্তিকা আছে। প্রায় পাঁচশো বছর আগের। ‘কারিকা’ সেটার নাম। আমার স্মৃতি যদি বিট্রে না করে, আপনাকে বলতে পারি সেই গদ্যের কিছু অংশ।’’    
লেবুবাগানের তিন তলার ছাদের মেঝেতে আসন ক’রে বসেন কমলকুমার। এক চুমুকে খেয়ে ফেলেন অনেকখানি মদ। চোখ বন্ধ ক’রে বলতে থাকেন অর্ধ-সহস্র বছর প্রাচীন এক বাঙলা গদ্য।
‘‘শ্রীশ্রীরাধাবিনোদ জয়। অথ বস্তু নির্ণয়। প্রথম শ্রীকৃষ্ণের গুণ নির্ণয়। শব্দগুণ গন্ধগুণ রূপগুণ রসগুণ স্পর্শগুণ এই পাঁচ গুণ। এই পঞ্চ গুণ শ্রীমতী রাধিকাতেও বসেশব্দগুণ কর্ণে গন্ধগুণ নাসাতে রূপগুণ নেত্রে রসগুণ অধরে ও স্পর্শগুণ অঙ্গে। এই পঞ্চগুণে পূর্ব্বরাগের উদয়। পূর্ব্বরাগের মূল দুই। হঠাৎ শ্রবণ ও অকস্মাৎ শ্রবণ।’’
কমলকুমার যেন তাঁর স্মৃতির পরীক্ষা দিতে বসেছেন। প্রাচীন বাঙলা গদ্যের সিন্দুক উপুড় ক’রে যাচ্ছেন একে একে। চোখ বন্ধ করেই আরও কিছুটা মদ্যপান করেন। একটু কাঁচা লঙ্কা কামড়ে বলতে থাকেন, ‘‘প্রায় তিন শ বছরের প্রাচীন একটি গদ্যপুঁথি বৃন্দাবনলীলা। তার একটি অংশ এবারে শ্রবণ করুন ভদ্রে।...’’   
‘‘তাহার উত্তরে এক পোয়া পথ চারণ পাহাড়ী পর্ব্বতের উপরে কৃষ্ণচন্দ্রের চরণচিহ্ন ধেনুবৎসের এবং উঠের এবং ছেলির এবং মহিশের এবং আর আর অনেকের পদচিহ্ন আছেন যে দিবস ধেনু লইয়া সেই পর্ব্বতে গিয়াছিলেন সে দিবস মুরলির গানে যমুনা উজান বহিয়াছিলেন এবং পাষাণ গলিয়াছিলেন সেই দিবস এই সকল পদচিহ্ন হইয়াছিলেন। গয়াতে গোবর্দ্ধনে এবং কাম্যবনে এবং চরণ পাহাড়েতে এই চারি স্থানে চিহ্ন এক সমতুল ইহাতে কিছু তরতম নাঞীচরণ পাহাড়ের উত্তরে বড় বেস শাহি তাহার উত্তরে ছোট বেস শাহি তাহাতে এক লক্ষ্মীনারায়ণের সেবা আছেন তাহার পূর্ব্ব দক্ষিণে সেরগড়। গোপীনাথজীর ঘেরার দক্ষিণ পশ্চিম নিধুবন চতুর্দ্দিগে পাকা প্রাচীর পূর্ব্বপশ্চিমা বন পশ্চিমদিগের দরওয়াজা কুঞ্জের ভিতর জাইতে বামদিগে এক অটালিকা অতি গোপনিয় স্থান অতি কোমল নানান পুষ্প বিকশিত কোকীলাদি নানান পক্ষী নানান মত ধ্বনি করিতেছেন বনের শৌন্দর্য্য কে বর্ণন করিবেক শ্রীবৃন্দাবনের মধ্যে মহন্তের ও মহাজনের ও রাজাদিগের বহু কুঞ্জ আছেন। নিধুবনের পশ্চিমে কিছু দূর হয় নিভৃত নিকুঞ্জ যে স্থানে ঠাকুরাণীজী ও সখি সকল লইয়া বেশবিন্যাষ করিতেন ঠাকুরাণীজীউর পদচিহ্ন অদ্যাবধি আছেন নিত্য পূজা হয়েন।’’                                
কমলকুমার চোখ খোলেন। ওঁর উচ্চারণ ভঙ্গি, ধ্বনি-সুষমা ও তার অভিঘাতে মন্ত্রমুগ্ধ স্থির ব’সে আছেন মাইকেল আর বঙ্কিম। কমলকুমার বলেন, ‘‘লক্ষ করুন এই গদ্যে অচেতন পদার্থসমূহের প্রতি কি গভীর সম্মানসূচক ক্রিয়াপদ। পদচিহ্ন, যমুনা, পাষাণ, কুঞ্জএদের প্রতি যে শ্রদ্ধার ভঙ্গি, এই স্ট্রাকচার আমাদের ছিল। প্রকৃতির সাথে এই প্রকার রিলেশনশিপ, এ’ আমাদের নিজস্ব সৃজন। নিজেদের অর্জনযেমন সংকীর্তন আমাদের নিজের। নানান পুষ্প বিকশিত কোকীলাদি নানান পক্ষী নানান মত ধ্বনি করিতেছেন, এই নির্মাণ হারিয়ে ফেলল জাতি। এবং তার চেয়েও বিপদ হচ্ছে মদ ফুরিয়ে গেছে। এই অবস্থায় মদ না খেলে তো হেঁটে বাড়ি ফিরবার শক্তিও হারিয়ে ফেলব আমি।’’
—‘‘বাঙলায় পরবর্তীকালের গদ্যে, ভাষার এই ব্যাকফুটে চলে যাওয়ার কারণ কী মনে হয় আপনার?’’ বঙ্কিম বলেন।
—‘‘কারণ অনেকগুলো। সবচেয়ে যেটা বড়, আমার মনে হয়, বাঙলা ভাষায় আজ অবধি একটাও অসাম্প্রদায়িক বাঙলা অভিধান পাওয়া গেল না। এপার বাঙলা ওপার বাঙলার সমস্ত অভিধানকেই মনে হয় সাম্প্রদায়িক। পশ্চিমবাঙলার বাঙলা অভিধানে সংস্কৃতজ শব্দের বাড়াবাড়িআর বাঙলাদেশের অভিধানে আরবি ফারসি উর্দু। দুটোকে মিলিয়ে একটা অভিধান এখনও হল না। তারপরে দুই বাঙলার জেলায় জেলায় যে আঞ্চলিক বাঙলা শব্দ, কোচবিহারের যে বাঙলা, মেদিনীপুরের বাঙলা, পুরুলিয়া বীরভূম বাঁকুড়া কিংবা মালদার বাঙলা, তা-ও তো জায়গা পায় না অভিধানে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ভাষার যে সংমিশ্রণ ঘটে, যে ভাষায় ঝগড়া করে মানুষ, প্রেম নিবেদন করে, শোকে হাউহাউ কাঁদে, রাতে সঙ্গমকালে ফিসফিস করে অনিবার্যভাবে যে ভাষায়, সে ভাষার নামগন্ধ নেই কোনও অভিধানে। রাজবংশী বাঙলায় যে শলায়া হ’ল ইঁদুর, শাকাই আত্মীয়, কুটুমএর’ম কত শব্দ কেউ জানল না। শকড়ি বা সকড়ার সাথে হুক্কৈড়কে জায়গা দিল না। জানতে দিল না ভাষার এই ঐতিহ্যকে। শুধু হিন্দি, ইংরেজি নয়, প্রমিত বাঙলাও তো খায় লোকায়ত বাঙলাকে। মূল ও গরিষ্ঠ বাঙলাকে। গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন, এশিয়াটিক সোসাইটি এরকম নানান প্রতিষ্ঠানে ফরাসি জার্মানি উর্দু আরবি শেখা যায়সিলেটি বাঙলা, মৈমনসিংহী বাঙলা শেখার কোনও জায়গা কি আছে? আমার জানা নেই। কী ক’রে নিজেকে জানব আমি? দেশ তো অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে বন্দরের লোনাজল মেখে। দেশ এবং দেশের মানুষের সংজ্ঞা ও এ-দুয়ের মধ্যে সম্পর্কটা অনেকটাই ইডিওলজি আর ফিলোসফির সংজ্ঞা ও এ-দুয়ের মধ্যে সম্পর্কের মতোই। অন্তত, এই শতাব্দীতে...’’   



‘‘আপনারা এখানেই বসুন’’, উঠে পড়েন কমলকুমার, ‘‘আমি নীচ থেকে আরও কয়েকটা বোতল তুলে আনি’’, সিঁড়ির দিকে চলে যেতে যেতে বলেন, ‘‘এসে আরেকটা গল্প শোনাব।’’
দেওয়াল ধ’রে ধ’রে টলতে টলতে সিঁড়ি ভেঙে নামেন। ছাদ থেকে কিছুক্ষণ শোনা যায় সিঁড়িতে ওঁর পায়ের শব্দ। তারপর মিলিয়ে যায়। খানিক বাদেই তিনটে লিডারের বোতল দু’ বগলে নিয়ে ফিরে আসেন। মুখে যুদ্ধজয়ের এক-গাল হাসি চওড়া হয়ে আছেআয়েস ক’রে ছড়িয়ে বসতে বসতে বলেন, ‘‘আঃ, বাঙলায় দেশি মদের বিবর্তন নিয়ে কেউ কিছু লিখেছে? লেখা দরকার। তাহলে একটা বিরাট পরিমাণ বাঙালির পাকস্থলী ও লিভার-শক্তির কিরূপ বিবর্তন হয়েছে তা ধরা পড়বে। অর্থাৎ তার ক্রম-ক্ষয়িষ্ণু জীবনশক্তির নিম্নগামী রেখাটা দেখা যাবে।’’ অপেক্ষা না ক’রে নিজেই ছিপি খোলেন একটি বোতলের। গ্লাসে টইটুম্বুর ঢালেন। ডান হাতের আংটি খুলে তাতে একবার একটু চুবিয়ে নেনতারপর ‘‘জয় মা’’ ব’লে এক-চুমুকে খালি হয়ে যায় পুরো গ্লাস।
 —‘‘গল্পটা বলবেন না?’’ বোতলের বাকি মদটুকু গ্লাসে ঢালতে ঢালতে মাইকেল বলেন
—‘‘বলব তো। সেজন্যেই তো এত কিছু। আবাহনী স্থাপনী সন্নিধাপনী সম্বোধনী সম্মুখীকরণী—পুজোয় ব্যবহৃত এই পাঁচ প্রকার অঙ্গুলিসন্নিবেশ ছাড়া পুজো সম্পূর্ণ হয় কখনও?’’
এক চিমটে আদা মুখে দেনটাগড়ায় টক্‌ টক্‌ শব্দ করেনচোখ বোঁজেন। 
‘‘মাধব, আমাতে যিনি আনন্দ, জয় যুক্ত হউন, জয় তারা ব্রহ্মময়ী জয় রামকৃষ্ণ
গল্পটার নাম ধরা যাক, পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আগে অন্ধকার যা ভাবছে এই গল্পের শুরুতে আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, ভারতীয় অধিকাংশ দার্শনিক মার্গে মৃত্যুকে বিয়োগ হিসেবে দেখা হয় না। এটা এই নীল রঙের গ্রহকে একটা বিরাট উপহার বৈকি। যেখানে মৃত্যু একটা যোগ চিহ্ন। এবং মৃত্যুকে একমাত্র যোগচিহ্ন দিয়েই প্রকাশ করা সম্ভব। ধরা যাক তোমার জীবন থেকে কেউ চলে গেল। ধরা যাক তোমাদের বিচ্ছেদই হয়ে গেল। এটুকু বললে কিন্তু সত্যিই অসম্পূর্ণ বলা। আসলে তোমার জীবনে যোগ হল তার চলে যাওয়া। তোমার জীবনে যোগ হল তার না-থাকা। মৃত্যু একটা যোগ চিহ্নই। জীবনের সাথে যোগই তো হল আরেকটা চ্যাপ্টার। আমি যখন চলে যাব, তখন আমার মরে যাওয়া, আমার চলে যাওয়াটাও যোগ হল আমার জীবনে। আরও একটা সংযোজন হল।  
তো, গল্পটা হল এই   
অন্ধকার প্রকৃতভাবেই চেয়েছিলেন এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে, চিরকালের জন্যপড়ে থাক এই গ্রহ তার আলোর গরব নিয়ে; সে জানলোও না আলো কখনও ভেতরের নয়সে বাইরের জিনিসঅন্ধকার থাকে ভেতরে; সে অন্তর্গতপ্রাণে পদার্থে বস্তুতে লীন থাকে সে, নির্যাসের শ্বাস প্রশ্বাসে সচল হয়েএই পৃথিবীর একমাত্র আদি ও আদিম অধিবাসী যদি কেউ হয়, তবে তিনি, অন্ধকার। প্রাণেরও আগেবায়ু, বৃষ্টি, জল, আগুন, খনি, মাটি, বৃক্ষ এমন কি আলোরও আগে তিনিই এসেছিলেন এই গ্রহে। তিনি ছিলেনএকমাত্র রাজা, অধীশতিনি করেছিলেন স্তন্যদান, প্রথম, এই গ্রহকে।
আজও, এত লক্ষ নিযুত বছর পরেও, জলের নীচে যাওঅন্ধকার।
মাটির নীচে দেখঅন্ধকার।
ধাতু খনি কাঠ ফাটিয়ে দেখঅন্ধকার।
শিলা খণ্ড করোঅন্ধকার।
গাছের কাণ্ডের ভেতরঅন্ধকার।
মানুষ কি যেকোনও প্রাণী, গোটা জীবজগতের দেহের ভেতরঅন্ধকার। জমাট, ধাতব অন্ধকার।
এই গ্রহ, এখনও, বয়ে চলেছে প্রথম স্তন্যপানের স্মৃতি। আলোর উৎস হয়। অন্ধকারের কোনও উৎস নেই। ছিল নানেইতিনি চলে গেলে কোনও ছায়া পড়বে না পৃথিবীতে। ছিবড়ের মতো পড়ে থাকবে নিঃশেষিত প্রাণ, বস্তুঅন্ধকারবিহীন যাদের অন্ত্র নাড়ি তন্তু কোষ ঝলসে যাবে আলোয়। বাতি নিবিয়ে দিলেও যেদিন অন্ধকার হবে নাবিজ্ঞানকে আবিষ্কার করতে হবে এমন বাতি যা অন্ধকার দেয়। নল দিয়ে ওষুধ দিয়ে মানুষের শরীরের ভেতরপেটের ভেতর পাঠাতে হবে কৃত্রিম অন্ধকার। মাটির নীচ থেকেখনির গর্ভ থেকে সরে যাবে যেদিন অন্ধকারসেই শূন্যস্থান কে পূরণ করবেকে? আলো? হা হা।      
আয়তনে ছোট কিন্তু উঁচু একটা পাথুরে টিলার ওপর ইঁটের দুর্গে ব’সে এইসমস্ত ভাবছিলেন অন্ধকার। দূরে কাছে আরও এমন শত শত মুঠো ভরা টিলা। কিছু দেখা যায়অধিক যায় না। রুখা দেশ। শুখা ভূঁই। ভুখা প্রাণ। নলের মতো কাঁটা গুল্ম লতাঅপটু নাপিতের দায়সারা কাজের মতো ন্যাড়া জমিতেবালকের খাপছাড়া চুল জেগে। ঝোপে ঝোপে লেগে আছে জমজমাট থোকা থোকা অন্ধকার। টিলার ওপর দিয়ে, দুর্গের ওপর দিয়ে মেঘের মতো ভেসে ভেসে যাচ্ছে কিছুটাটিলার গায়ে লেগে ঝুর ঝুর তরলের মতো নেতিয়ে চুঁইয়ে পড়ছেশিলা পাথর মাটি ইঁট ধুলোর গা বেয়ে। মাটিতে ভেসে যাচ্ছে অন্ধকারের ভঙ্গুর অংশ। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার ভাবনা নিয়েদীর্ঘকাল একটা ফণিমনসার ডাল চিবুতে চিবুতে অনেকটা উঁচু টিলার ওপর দুর্গের ভেতর থেকে এইসব দেখছেন রাজা অন্ধকার। দেখছেন ফোঁটায় ফোঁটায় বিদ্ধ তাঁর জানিত অজানিত বিরাজমানতা। এখানে নেই ক্ষিপ্ত গোলমালের ছ্যাঁকাফণিমনসার পাতা কিভাবে তার ক্ষুধা নিবৃত্ত করছে একমনে অনুভব করা যায়অন্ধকার গভীরভাবে লক্ষ করেন তাঁর দাঁত লালা জিহ্বা টাগড়ায় কিভাবে ফণিমনসার পুরুষ্টু পাতা চূর্ণ হয়ে মণ্ড হচ্ছে। খেতে খেতে আকাশের দিকে চানচেয়েই থাকেন, আরও কয়েক যুগ কেটে যায় এভাবে চেয়ে থাকতেদূরে মহা আকাশে শূন্যে কি বিপুল ছড়িয়ে আছে তাঁর একচ্ছত্র সাম্রাজ্যভাবেন; ভাবতে ভাবতে আরও কয়েক সহস্র বছরআলোর কণামাত্রও যেখানে পৌঁছবার চিন্তা করেনি, এখনও; সেই শূন্য এখনও পুষ্ট হয়ে আছে নিয়তাকার দানায় পরিণত এই অন্ধকারে; এই গাঢ় ও গুপ্ত তরঙ্গের বিশাল উচ্চতা, গতি, থৈ, ব্যাপ্ত ও তীব্র প্রতিভা, নিজেকে চাবকে চুল ছিঁড়ে মরিচীমালীহীন নিবাত নিকম্প উলঙ্গ দাঁড়িয়ে আছেন যিনি, খালুই নিয়ে তাঁকে ছেঁচতে এসেছে বোকা মানুষজানে না, যথানিয়মে যজ্ঞ অনুষ্ঠানে স্তূপাকারে সজ্জিত স্বর্ণ এবং অন্যান্য ধাতু সমাহারে শূন্য আজও তাঁর পূজারী। আলো তাঁর চির বৈর-প্রতিরথ। যে কুটিল বক্র নিনীষা নিয়ে আলো এসেছে এই ব্রহ্মাণ্ডে, অন্ধকার তা নয়তিনি কখনও চাননি প্রকৃতিকে প্রাণকে বস্তুকে জগৎ ও জীবনকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যেতেউদ্বাসিতর যন্ত্রণা তিনি কোনওদিন দিতে চাননি শূন্যকে। তিনি শুধু অভিলাষ রেখেছেন ঈক্ষমান থাকার। প্রকৃতি তবু ভুললেন আলোর ময়ূরপুচ্ছ দেখে। ভুললেন এমন একজনের কথায় যে ছুটে চলেছে লক্ষ মাইল বেগেযে দু দণ্ড দাঁড়াতে শেখেনি স্থির। অন্ধকার শিখেছে কী করে চেয়ে থাকতে হয় বিরাট ব্রহ্মাণ্ডেকী করে শুধু থেমে থাকতে হয়। থেমে থাকার বিশ্বাস। সময়, বায়ু, আলোকেউ অর্জন করেনি এই শিক্ষা। তারাভাষ্য, আপনি একটু নুন ও সামান্য জয় ভেঙে দূরান্বয়ী আলোর পসরা কষছেনধুন ও উপাদানগুলি কাদায় দেখা সংশ্লিষ্ট ক্রূর, আত্মবাস্তবিক নক্ষত্র কাউকে ছাড়ে না। বৃত্ততান্ত্রিক গুটিকয় ঘাসের আকাশ, তার আপাত ব্যর্থ শান্তিকল্যাণের ভেতর মন্থর সঙ্গম শিখেছেন, তিনি, অন্ধকার অগাধ ভৌত জড়ো করে তারাদের ভুঁড়ি কুঁজ প্লীহা রক্ত, ষান্মাসিক লাল ফল, শব্দের অপযশ, সব শিথিল করে তিনি আজ চলে যাবেন সারবান ভপঞ্জরে।     
এদিকে, অন্ধকার যেখানে বসেছিলেন, সেই টিলার পাশ দিয়ে, শুকনো ফাটা মাটিতে সারি বেঁধে চলেছে পিঁপড়ে। বিষাক্ত লাল পাহাড়ী ডেঁয়ো। খাদ্যসংস্থানে। অথবা নিজগৃহ পথে। মগ্ন, শৃঙ্খলাবদ্ধ, নিবিড়ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে দিক নিরূপণ করে চলেছে। জগতে আর কোত্থাও কোনও কিচ্ছুতে ধ্যান নেই। কোনও ছন্দ পতন নেই। কোনও বিশৃঙ্খলা, কিচ্ছু না। অন্ধকারের আরও কয়েক যুগ চলে যায় সেদিকে চেয়েফিরে দেখেন, পিঁপড়েরা তখনও চলেছে, সারিবদ্ধ, শৃঙ্খলাপরায়ণ।
ভাবেন, রাজা তো হয়েছি, এবারে ঋষি হই। তবে এই জীবনের ফলিতার্থ সম্পূর্ণ বুঝবরাজার খেয়াল। এই ভেবে, রাজা অন্ধকার দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসেন। নেমে আসেন টিলা থেকেমাটির ওপর দাঁড়িয়ে একবার ফিরে তাকান নিজের বিপুল সাম্রাজ্যের দিকে। তাঁর পায়ের পাশ দিয়ে কি আবিষ্ট সংযমনে চলেছে ডেঁয়োরা। পাথর, শিলা, নুড়ি, কাঁকর, অসমান-ভূমি সব গ্রহণ করেই তার উপচিতি। অন্ধকার ত্যাগ করেন তাঁর যজ্ঞসূত্র, নির্মোক। মুহূর্তে বৃহদাকার একটি পৃথুলা মৃত মথে পরিণত করেন নিজেকে এবং ফেলে দেন নিবিড় নিয়মে চলা ডেঁয়োদের পঙক্তির পাশে। পেছনে পড়ে থাকে সাম্রাজ্যের সব তরবারি শক্তি ধনুক কুঠার বর্ম। ঈষদ্ভিন্ন আলোও তখন সেখানে নেইকিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত মথটির গন্ধ পৌঁছে যায় লাল পিঁপড়েদের কাছে। যথানিয়মে তারা নিজেদের অভিমুখ ঘুরিয়ে আনে সেদিকে।’’ 
  (চলবে)

1 comment:

  1. অন্ধকার তোমার ছায়া কোথায়!!! যেমন ভালো লাগে তোমার গদ্য তেমনি

    ReplyDelete