বাক্ ১০৭ : 'আমি তারে পারি না এড়াতে' : প্রদোষ পাল



প্রথম দৃশ্যঃ ১২ বা ১৩ বছরের একটি কিশোরী, সঙ্গে তার ভাই, আনুমানিক বয়স ৫ কিংবা ৬, ছুটতে ছুটতে রেল স্টেশনে এসে উপস্থিত হলো। স্টেশনের মাইকে তখন  ঘোষণা চলছে ২৯০ নং ইন্টারন্যাশেনাল ট্রেন ১ নং ট্র্যাক থেকে রাত ১১টায় জার্মানির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে কিশোরী ও তার ভাইয়ের আগমণ দেখে বোঝা যায় তারা ট্রেন ধরতেই এসেছেপ্লাটফর্মের একজন হকার তাদের দেখে শুধায় - ‘আবার তোমরা এখানে? কিন্তু তোমরা প্রতি রাতে কেন এখানে আসো?’ বোঝা যায় এভাবেই দিদি ও ভাই রোজ রাতে ট্রেন ধরতে আসে, কিন্তু ধরেনি বা ধরতে পারেনি। স্টেশনে দাঁড়াতে দেখা গেল একটি ট্রেনকে। মাইকে ঘোষণা শোনা যায় জার্মানির উদ্দেশ্যে ট্রেন ছেড়ে যাবে দিদি ও ভাই দুজনেই ট্রেনের গেটের সামনে ছুটে যায়, কিন্তু উঠল না। ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।         
     পরের দৃশ্যঃ পর্দা জুড়ে শুধু অন্ধকার। চাপা কন্ঠস্বর। দিদি ভাইকে বলছে- ‘ঘুমিয়ে পড়’। ভাই বলে- ‘কখন আবার আমরা যাবো?’ দিদি বলে- ‘এখন ঘুমো’‘আমাকে গল্প বলবে না?’ ‘পরে’  পর্দা জুড়ে তখনও অন্ধকার। ফিসফিস করে কয়েকটা কথা ভেসে আসে কিশোরীর কন্ঠ থেকে -In the beginning there was a Chaos ... and then the light was made... and the light was seperated from the darkness... and earth from the sea... and then the rivers, the lake and mountains were formed... and then the flowers, and the trees and animals, the birds...” ‘এই মা আসছে। দিদি গল্প থামায়। ভাই বলে- ‘তুমি কখনই গল্প শেষ করবে না!’ 
ভাই বোন লেপ মুড়ি দিয়ে শোয়ার ভান করে থাকেঘরের দরজা খুলে যায়দরজার বাইর থেকে তীব্র আলো দুজনের লেপমোড়া শরীরে গিয়ে পড়ে। আলোর বিপরীতে একটি ছায়া। কোনো স্ত্রীলোকেরই মনে হয়। তাদের মা? হতেও পারে।          
    আবার তারা স্টেশনে একই রকম মাইকে ঘোষণা- ২৯০ নং ইন্টারন্যাশনাল ট্রেন ১ নং ট্র্যাক থেকে রাত ১১টায় জার্মানির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। প্লাটফর্মের হকার তাদের দিকে এবার আড়চোখে তাকাল, কিছু বলল না। দিদি ও ভাই ট্রেনের গেটের কাছে এগিয়ে গেল ছাড়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তারা উঠে পড়লো ট্রেনে।     
     উঠে প্রথম কথা বলে বালকটি –‘আমরা পেরেছি কিশোরী দিদি কিছুক্ষ বিহ্বল দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাইকে বুকে টেনে নেয়। অবশেষে তারা যে পেরেছে সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বহুক্ষ দুজন দুজনকে জড়িয়ে থাকে।   
      বলাই বাহুল্য ওরা ট্রেনের টিকিট কাটতে পারেনি। গেটের ধারে মেঝের এক পাশে ভাই বোনকে ঘুমোতে দেখা যায়। ঘুমের মধ্যে মেয়েটি যেন বাবার সঙ্গে কথা বলে চলে... “Dear father, we are writing you because we want to come and see you. We’ve never seen you and we need you. We speak you all the times. Mom will get sad with our departure, but don’t think that, it will stop us. And then she should’t understand. We don’t know what you’re like. Alexandro says many things. He sees you in a dreams. We need you so bad. And somtimes, when I’m going home from school. I hear footsteps behind me: your footsteps. And when I turn around and look nobody’s there. And so I feel very lonely. We do’n want to be a burden to you, only meet you, then leave, If you answer to us, and do it with the sound of the train. Ta-tan, ta-tan, ta-tan, ta-tan. I am here... I’m wating for you.... ta-tan, ta-tan”
     কে তাদের বাবা? কোথায় তাদের বাবা থাকে, তারা জানে কি? হয়ত শুনেছে বাবা জার্মানিতে থাকে। কিন্তু জার্মানির কোন শহরে? কিছুই জানে না তারা। তবুও বাবার সঙ্গে দেখা করার তীব্র ইচ্ছায় তারা জার্মানির ট্রেনে চেপে পড়লো।  
 
        এভাবেই শুরু হয় ‘ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট’ ছবিটি। ১৯৯০ সালের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখেছিলাম। গ্রীসের পরিচালক অ্যাঞ্জেলোপৌলজের ছবি। কেন এতোদিন পর ওই ছবিটি নিয়ে আলোচনায় বসলাম, সে নিয়ে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। কিছুটা ব্যক্তিগত তো বটেই। বাকিটা দেখা যাক! 
     আর্টকলেজ থেকে পাশ করেছি বছর দুয়েক আগে (১৯৮৮)। কলেজ থেকে বেরনোর পর দু বছর ফ্যা ফ্যা ঘুরে বেড়িয়ে কিছুটা থিতু হয়েছি তখন। সেবার, মানে ১৯৯০ সালে আমার প্রথম একক প্রদর্শনী হতে চলেছে। প্রদর্শনীর প্রস্তুতির মধ্যেই হুড়মুড় করে এসে পড়লো ওই চলচ্চিত্র উৎসব। অনেকে হয়তো গুলিয়ে ফেলতে পারেন তাই একটু বলে নেওয়া ভাল চলচ্চিত্র উৎসব কিন্তু আজকালকার রাজ্য সরকারের কোষাগার ধ্বংস করে বলিউডের শায়েনশা, বাদশা, বিগ বস, তাঁর পরিবার আর লোকাল ঝিঙ্কু মামনিদের ঝেঁটিয়ে এনে করা হতো না। ঐ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ভারত সরকারের আয়োজনেই হতো। যথার্থই আন্তর্জাতিক মানের। শেষ এমন চলচ্চিত্র উৎসব হয়েছে ১৯৯৪ সালে। জানুয়ারির ১০ তারিখে শুরু হতো। চলতো ১০ দিনযে ভাবে ‘ন্যাশেনাল এগজিবিশন অফ আর্ট’ বিভিন্ন শহরে ঘোরা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সেভাবেই ওই ‘ইন্টারন্যাশেনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল’ও দেশের বিভিন্ন শহরে ঘোরা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন প্রতিবছর একমাত্র গোয়াতেই এই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হয়। মোটামুটি দেখা গিয়েছে ৪ বছর অন্তর ওই চলচ্চিত্র উৎসব কলকাতার ভাগ্যে জুটতো। সেটা বন্ধ হওয়ার পর তৎকালীন সাংস্কৃতিক মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অনেকটা জেদের বশেই বর্তমানে চালু চলচ্চিত্র উৎসবটির আয়োজন করেন। তাঁর সৎ উদ্দেশ্যকে বাহবা দিতেই হবে। কিন্তু তিনি চান বা না চান যে উদ্দেশ্যে এই উৎসবের প্রচলন তা আর বজায় থাকল না। এক বিশেষ শ্রেণির দেখনদারি আলট্রা ইন্টেলেকচুয়েলদের খপ্পরে পড়ে গেল। আর পরিবর্তনের পর বর্তমানে তো সে গাঁট ছাড়াতে আর এক গাঁটের কব্জায় গিয়ে পড়েছে কোটি কোটি রাজ্য-কোষাগারের টাকা ধ্বংস করে আয়োজনের চাকচিক্য বাড়ল, কিন্তু মান? আন্তর্জাতিকতা! শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ, বাবা কেন চাকর, বৌ কথা কও’র পরিচালক, অভিনেতা অভিনেত্রীদের যদি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব  পরিচালনার শিখরে বসানো হয় তবে যা হওয়ার তাই তো হবে! যাক সে সব কথা কূটকচালি আর না বাড়িয়ে আলোচনায় ফেরা যাক।   
             
     তো যেটা বলছিলাম, প্রথম একক প্রদর্শনীর প্রস্তুতি আর চলচ্চিত্র উৎসব। ব্যাগভর্তি প্রদর্শনীর আমন্ত্রনপত্র নিয়ে ঘুরছি কিন্তু দেওয়া আর হয়ে উঠছে না কাউকে। রাতভর লাইন দিয়ে টিকিট কাটা আর সিনেমা হলে ঢুকে পড়া। এক একদিনে চারটা পাঁচটা সিনেমাও দেখেছি। ১০ দিনে কতই সিনেমা দেখলাম কিন্তু আজ এতো বছর পর মনে আছে ওই একটিরই কথা। সেবার অ্যাঞ্জেলোপৌলজের ১৯৮৮ সালে নির্মিত ‘ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট’ উৎসবের  উদ্বোধনী ছবি হিসেবে দেখানো হয়েছিল। আমি দেখেছিলাম লাইটহাউস সিনেমা হলে। বর্তমানে হলটির অস্তিত্ব আর নেই। বিগ বাজারে রূপান্তরিত হয়েছে      
     তখনও বুনুয়েল, ফেলিনি, বার্গম্যান দেখিনি। বাইসাইকেল থিবস দেখিনি। ফলে ও ছবি আমার জীবনে এক অন্য স্বাদ, অন্য প্রবাহে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার সন্ধীক্ষন।   
    আবার ‘ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট’এ আসা যাক। ছবির নীলচে রং, কুয়াশা, বৃষ্টিভেজা মাটি আর রাস্তাঘাট দেখলেই বোঝা যায় এ ‘ল্যান্ডস্কেপ’ যথার্থই ‘মিস্ট’এর ল্যান্ডস্কেপ। এক অদ্ভুত অ্যাঙ্গেলে ক্যামেরাকে ধরা হয়েছে। কারখানার চিমিনি, নগর সভ্যতার অট্টালিকা, হাওয়া কল এমনকী যানবাহন, সবকেই দেখানো হয়েছে অতিকায়ভাবে। আর মানুষজনকে দেখানো হয়েছে অতি ক্ষুদ্র আকারে। ছবির মানুষজনের সাজপোশাক কালচে। একজনকেও উজ্জ্বল বা সাদা পোশাকের দেখা গেল না। এ এক ব্যখ্যার বাইরে অনুভবের ছবি। ছবির প্রতিটি ফ্রেম গভীরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পরতে পরতে ভাবনার ডানা উড়তে থাকে। প্রতিটি ফ্রেমই যেন এক একটি পেইন্টিং। নিজে একটু আধটু আঁকাআঁকি করি তাই হয়তো আমাকে একটু বেশি ভাবিয়েছে। সারা ছবি জুড়ে সিম্বলিস্ট নিদর্শনের ছড়াছড়ি। আশ্চর্য এক ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলের মধ্য দিয়ে আমরা সে সব দেখতে পাই। কখনও দেখি বিশাল এক সমুদ্র প্রান্তরে নাটকের কুশীলবদের জামাকাপড় ঝুলছে। হাওয়ায় পতপত করে দুলছে। মনে হয় যেন মানুষগুলোকেই লটকে দেওয়া হয়েছে দড়িতে। একবার ডেভিডের পাঞ্জার মতো দেখতে বিশালাকৃতি একটি সিমেন্টের কাটা পাঞ্জা লেকে ভাসতে দেখা যায়। হেলিকপ্টার উড়ে এসে সেই বিশাল পাঞ্জাটিকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। শহর নগরের অট্টালিকার ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার যখন পাঞ্জাটিকে লোহার তারে বেঁধে উড়িয়ে নিয়ে যায়, তখন যেন গায়ে কাঁটা দেয়। দেশ বিদেশের অনেক সিনেমা দেখেছি কিন্তু এমন আশ্চর্য উপস্থাপনা খুব একটা দেখিনি। 
    
      আর একটু ঘটনায় আসা যাক। বিনা টিকিটের ভাই বোনকে টিকিট চেকার ধরে ট্রেন থেকে এক স্টেশনে নামালো। পরে পুলিশের সহায়তায় কারখানায় কর্মরত ওদের মামার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো মামাকে জানানো হলো বাবার সঙ্গে দেখা করতে ওদের জার্মানি যাওয়ার ব্যাপারটা। মামা একান্তে পুলিশকে জানাল ওদের বাবা টাবা কেউ নেই। সব স্বপ্নে দেখা গপ্পো। ‘স্বপ্নে দেখা গপ্পো’? এই কথাটাই যেন ছবির মূল ভাবনা। ক’জন পারে এমন স্বপ্ন দেখতে? ক’জন পারে এমন স্বপ্নে বাবার সঙ্গে কথা বলতে? কোনো ঠিকানা ছাড়াই সেই অজানা বাবার সঙ্গে দেখা করতে এভাবে বেরিয়ে পড়তে কে পারে? মনটা হু হু করে ওঠে। বিশাল রহস্যময় নির্লিপ্ত পৃথিবীতে দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ের একমাত্র চাওয়া বাবার সঙ্গে দেখা করা। অথচ কিছুই জানে না তারা বাবার সম্পর্কে
        পুলিশের হাত থেকে এক অভিনব সুযোগে তারা পালাল। সেদিন শহরে তুষারপাত শুরু। তা দেখতে সবাই বেরিয়ে এল রাস্তায়। পুলিশ ভুলেই গেল ছেলেমেয়ে দুটিকে ধরে এনেছে। সেও সবার সাথে বেরিয়ে এল রাস্তায় তুষারপাত দেখতে। সেই সুযোগে দিদি ও ভাই বেরিয়ে গেলো। কেউ তাকালই না তাদের দিকে। সবাই স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাস্তার মানুষজন সবাই স্ট্যাচুর মতো স্থির। বাচ্চাদুটো তার মধ্যদিয়ে ছুটতে ছুটতে চম্পট দিল। অনেকটা যেন গুপী বাঘার গান ও বাজনা শুনে রাজদরবারের সবাই যেভাবে স্থানু হয়ে পড়ছিল ‘গুপী গায়েন বাঘা বায়েন’ সিনেমাতে। সেখানে গান আর এখানে তুষারপাত। 

       আর তারা ট্রেনে ওঠার সাহস পেল না। পায়ে হেঁটেই পাড়ি দেওয়া শুরু করলো জার্মানির উদ্দেশ্যে। একদিকে স্বপ্ন আর একদিকে রয়েছে বাস্তবের নির্মমতাএক পথ থেকে আর এক পথে পায়ে হেঁটে যেতে যেতে ভাইটি থমকে দাঁড়া্য, আর পারছে না সে হাঁটতে। হাইওয়ে দিয়ে হুস হুস করে বেরিয়ে যাচ্ছিল একের পর এক গাড়ি। দিদি হাত নেড়ে দাঁড় করাতে চাইছে কোনো একটা গাড়িকে, কিন্তু কেউ দাঁড়াচ্ছে না। অনেক পরে একটি ট্রাক দাঁড়াল। উঠবে কি উঠবে না ভেবেও উঠে পড়ল ট্রাকেনির্মম বাস্তব পৃথিবীতে যা হয়, বাবার বয়সী সেই ট্রাক ড্রাইভারের দ্বারাই একসময় কিশোরীটি ধর্ষিত হলো। ছোট্ট আলতো পা বেয়ে নেমে আসে পাশবিকতার চিহ্ন এঁকে রক্তের ধারা। বাচ্চা মেয়েটি তার কুমারীত্ব হরণের রক্ত হাতে মেখে ট্রাকের দেওয়ালে ছবি আঁকে। একটি গাছের ছবি। 
       
       মেয়েটি জগতের ওপর যেন সমস্ত বিশ্বাসই হারিয়ে ফেলেছে। শুধু একটি বিশ্বাসে অবিচল, বাবার সঙ্গে দেখা তারা করবেই। সরলতা যেভাবে সব যুক্তি উড়িয়ে নিয়ে যায় এ ক্ষেত্রেও তাই একটি যুবকের সঙ্গে আলাপ হলো। যুবকটি ভ্রাম্যমান একটি নাটকের দলের সঙ্গে যুক্ত। গাড়িকরে বিভিন্ন সাজপোশাক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ঘটনাচক্রে ছেলেটির সঙ্গে ওদের আলাপ হলো। সংকোচ দ্বিধা ভয় দূরে সরিয়ে যখন ছেলেটির ওপর ভালোবাসা অনুভূত হলো, তাকেই ভালোবাসতে চাইল উজাড় করে, ঠিক তখনই আবার নির্মম বাস্তবের মাটিতে আছাড় খেল কিশোরীটি। আবিষ্কার করল ছেলেটি আর এক সমবয়সী ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িত। ছেলেটি ওদের ট্রেন ভাড়া জোগাড় করতে নিজের মোটরসাইকেল বিক্রি করলো, কিন্তু কিশোরীটি তার কাছ থেকে কোনো অর্থ গ্রহন করলো না। স্টেশনে একজন অল্পবয়সী সৈনিকের আছে মেয়েটি ট্রেন ভাড়ার টাকা চাইল। বিনিময়ে ইজ্জত দিতেও সে পিছপা ছিলনা। সৈনিক ছেলেটি পেটে খিদে মুখে লাজ গোছের ভাব করে বহুক্ষন ঘন ঘন সিগারেট টেনেও শেষ পর্যন্ত মেয়েটির কোনো ক্ষতি করলো না। ট্রেনের ভাড়া দিয়ে দিল। আনন্দে নাচতে নাচতে টিকিট কেটে এবার সিটে গিয়ে বসল। মুখে তৃপ্তির হাসি। যদিও বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না। এক দেশ থেকে আর এক দেশে যেতে শুধু টিকিট কাটলেই চলেনা, পাসপোর্ট ভিসা লাগে। ওই টুকু বাচ্চাদের যা জানা সম্ভব ছিল না। আবার তারা ট্রেন থেকে নেমে চম্পট দিল। বর্ডার সিকিউরিটির চোখে ধুলো দিয়ে এক সময় সীমানার প্রান্তে এসে দাঁড়াল তারা।  
         ছবির শেষ দৃশ্য... পর্দা একদম সাদা। বেশ কয়েক মিনিট পর কুয়াশা ভেদ করে ভাইবোনের অবয়ব আবছা ভাবে দেখা যায়। ঘন কুয়াশার মধ্যদিয়ে এক বিশাল প্রান্তরের সীমানার দিকে চলেছে। দূরে কুয়াশা ভেদ করে আবছা ভাবে একটি গাছ দেখা যায়। বার বার ছবিতে এই গাছের অবয়ব এসেছে প্রতীকী হয়ে। কুমারীত্ব হরণের রক্ত দিয়েও কিশোরীটি ঐ গাছ এঁকেছিল। রাস্তার আবর্জনা থেকে যুবকটি একটি কাটা ফিল্ম বাচ্চাছেলেটিকে দিয়েছিল। ঝাপসা হয়ে যাওয়া ফিল্মটিতেও অস্পষ্টভাবে দেখাগিয়েছিল একটি গাছ। যে গাছটিকেই ছবির শেষ দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই। ওটাই বর্ডারের সীমানা। ওটাই ওদের ডেস্টিনেশন। স্বপ্ন যেমন অস্পষ্ট রহস্যময় হয়। ওই রহস্যময় গাছের কছে গেলেই যেন বাবার সাথে দেখা হয়ে যাবে। দুজনে ছুটতে ছুটতে গাছের কাছে গেল। একসময় ওই গাছের মধ্যেই লীন হয়ে গেল দুজনে। ছবি শেষ হয়। 

      ফেস্টিভাল শেষ হলো। আমার জীবনের প্রথম প্রদর্শনী শুরু হতে মাত্র দিন সাতেক বাকি। মাথায় গিজগিজ করছে অজস্র ছবির ভাবনা। কিন্তু বাস্তবে সমস্ত কিছু জোগাড় করে ছবি আঁকা এতো সোজা ছিল না তখনকলেজ থেকে বেরিয়েছি বছর দেড়েক। চাকরি নেই। ভাড়াবাড়িতে থাকি। করেকম্মে মোটামুটি চলে যাচ্ছিল। চাইলেই দ্রুত রঙ ক্যানভাস জোগাড় করে ফেলা এতো সোজা নয়। আর প্রদর্শনীর আয়োজনের হাজারো ব্যস্ততা তো ছিলইতবু ক্যানভাসে দুটো ছবি আঁকতে পেরেছিলাম। একটা বিক্রি হয়ে গিয়েছে। নাম ‘দ্য প্লাটর্ফম’। বিশাল প্রান্তরে একটি প্লাটর্ফম। মানুষের মতো দেখতে কিছু অবয়ব হেঁটে চলেছে। যাদের মুখ নেই, শরীরও যেন নেই। শুধু জামাকাপড়গুলোই যেন মানুষের মতো হেঁটে চলেছে। এর কোনো ইমেজ নেই। হয়তো ছিল। আজ নেই। আর একটা ‘ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট’। জামাকাপড় ঝোলার মূল ফর্ম ওই সিনেমা থেকেই নেওয়া হয়েছে। বরফসাদা ভূমিতে উলঙ্গ কিছু মানুষ জুবুথুবু হয়ে যেন আগুন পোহাচ্ছে। পেছনে পতপত করে ঝুলছে জামাকাপড়। এই ইমেমজটা রয়েছে। সেটা দেখালাম। দুটো ছবির মাপই ৩৬/৪২ ইঞ্চি। ক্যানভাসে তেল রঙের সঙ্গে বাড়ি রং করা সাদা প্লাস্টিক কালার মিশিয়ে করা।  

  
      সিনেমার ওপর এতো ভালোবাসা গড়ে ওঠা যেন ওই ‘ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট’-এর হাত ধরেই। পরে দেশ বিদেশের বহু বিখ্যাত সিনেমা দেখেছি, দেখছি। কিন্তু ‘ল্যান্ডস্কেপ ইন দ্য মিস্ট’ আজও আমার কাছে অন্য এক আসনে আসীন। কেন আমি নিজেও জানি না। যেটুকু সিনেমাবোধ যেন তারই হাত ধরে। ‘আমি তারে পারি না এড়াতে, আমি চলি সেও চলে’।          



9 comments:

  1. ফিল্ম নিয়ে কি আর কিছু লিখেছেন? খুব লোভ হচ্ছে সেগুল পড়ার। লেখাটা চমৎকার। ফিল্মটাও দেখলাম আপনার চোখ দিয়ে। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  2. 'বাক'এ নিয়মিত লিখবো। অমিত কুমার বিশ্বাস আপনাকে ধন্যবাদ ছবিটি দেখার জন্য।

    ReplyDelete
  3. ভাল হয় তবে। খুবই ভাল। পড়ব। খেয়াল রাখব, আপনার পরের লেখার জন্য। ভাল থাকুন।

    ReplyDelete
  4. আর-একটি কথা, আমি তো পেন্টিং বুঝি না, শেখা বা দেখা দুটোর একটারও সুযোগ হয়নি। হৃদয় দিয়ে অনুভব চেষ্টা করি সামান্য। তা আপনার পেন্টিংটা ( ভুল না করলে শেষেরটি, তেমনই ইঙ্গিত ছিল) খুব ভাল লেগেছে। ভাবিয়েছে।

    ReplyDelete
  5. একজন মুগ্ধ পাঠক হিসেবে জানাই অনেক অনেক শুভেচ্ছা

    ReplyDelete
  6. ছবি দেখতে শিখলাম দাদা।
    খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  7. অসাধারণ লেখা.....সমৃদ্ধ হলাম.....

    ReplyDelete
  8. অসাধারণ লেখা.....সমৃদ্ধ হলাম.....

    ReplyDelete